পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোনে পরিনত করেছে ঠিকই। কিন্তু দক্ষিণের জেলা ঝালকাঠির বিসিক শিল্প নগরীতে এর কোন প্রভান নেই। এ কারণে বিসিক নগরীর শিল্প উদ্যোক্তারা প্লট নিয়েও অবকাঠামো নির্মানসহ উৎপাদনেই আসতে পারেনি। ৭৯ টির মধ্যে ৭৭ টি প্লটই ফাঁকা। প্লটের অধিক মূল্য এবং ব্যাংক লোন না পাওয়ায় হতাশ হয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে অধিকাংশ শিল্প উদ্যোক্তারা। ইতিমধেই জামাল শরীফ নামের ১ উদ্যোক্তা তার ২টি প্লটের বরাদ্দ বাতিল চেয়ে আবেদন করেছে।
ঝালকাঠি বিসিক শিল্প নগরীতে ৭৯ টির মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৭ জন উদ্যোক্তাকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫০ টি। এদের মধ্যে ২টি ছাড়া উৎপাদনে আসতে কেহই। উৎপাদনে আসা কারখানা দুটি হলো সারেং ফার্নিচার ও রাইসা পলিমার। বাকি ১ জন উদ্যোক্তার বিপরীতে ২৫টি প্লট বরাদ্দের অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন। অপর ৪টির মধ্যে ৩টি আবেদন জমা হয়েছে বলে বিসিক সূত্রে জানাযায়।
পদ্মা সেতু দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে এশিয়ান হাইওয়েতে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বেড়েছে কর্মসংস্থান। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা, বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলার সাধারণ মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে শুরু করেছে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর খুলনা বিভাগে বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু ঝালকাঠি বিসিকে প্লট বরাদ্দ নিলেও শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী হচ্ছেনা উদ্যাক্তারা।
২০১৪ সনের জুলাই মাসে শিল্প নগরীর কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০১৯ এর জুন মাসে। শহরের সুতালরী খাল সংলগ্ন বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ১১.০৮ একর জমির উপর ঝালকাঠি বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন করা হয়। ১৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮.২৬ একরে ৭৯টি প্লট করা হয়েছে। ২০১৯ এর নভেম্বরে প্লট বরাদ্দ শুরু হয়।
ঝালকাঠি বিসিকে সৌদি প্রবাসী হাফিজুর রহমান খাটি সরিষার তৈলসহ পন্য উৎপাদনের জন্য ৪টি প্লট বরাদ্দ নিয়ে গড়ে তোলেন খাটি সরিষার অয়েল এন্ড এগ্রো ইন্ডাষ্ট্রি। নিজের পুজি ও পৈত্রিক কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় অবকাঠামো ও যন্ত্রাংশ সংযোজন করেন। দৈনিক এখান থেকে ৫ মেট্রিক টন সরিষার তৈল উৎপাদন হবার আশংকা করছে এই উদ্যোক্তা। এখানে ভুট্টা ভেঙ্গে গবাদি পশুর গো-খাদ্য ও মাছের ফিড তৈরির মেশিনও বসানো হচ্ছে।
তিনি আরও দাবি করেন ২০২১ সালে প্লট বরাদ্দ পেয়ে দ্রুত গতিতে কাজ শুরু করলেও করোনাজনিত পরিস্থিতির কারণে তার এই উদ্যোগ থেমে থাকে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে অবকাঠামো কাজসহ মেশিনারী সংযোজনের কাজ শুরু করে চালু করতে দেরি হয়েছে। তবে জিনিষপত্রের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২১ সাল থেকে ৪০% খরচ বেড়ে যায়।
তার এই শিল্প কারখানায় উৎপাদন পর্যায় আসতে আরও ১ কোটি টাকা প্রয়োজন। বিসিকের জমি বন্দক রেখে ঋণের জন্য ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করছেন উদ্যোক্তা হাফিজুর রহমান। ৯ মাস ধরে ইসলামি ব্যাংক ও আল আরাফা ব্যাংক লোন দেওয়ার কথা বলে সময় ক্ষেপন করলেও তারা লোন দেয়নি বলে তিনি জানান।
অবশেষে আরেকটি ব্যাংকের সাথে কথা বলে লোন নেয়ার চেষ্ঠা চালাচ্ছেন তিনি। শিল্প নগরীতে মালয়শিয়া প্রবাসী আরেক শিল্প উদ্যোক্তা সিকদার টিস্যু ব্যাগ প্রকল্পের মালিক হানিফ সিকদার বাদল। তিনি জানালেন, আমার টিস্যু ব্যাগ তৈরীর কারখানা বিনয়কাঠিতে চালু আছে স্বল্প পরিষরে। তাই বিসিকে প্লট নিয়ে বড় আকারে কার্যক্রম শুরু করতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু ৩ কিস্তিতে ১০ লাখের উপরে টাকা দিলেও সেখানে এ পর্যন্ত কিছুই করতে পারিনি।
এ বিষয়ে আমি ইসলামী ব্যাংকের কাছে মেশিন ক্রয়ের জন্য লোনের আবেদন করেও সাড়া না পেয়ে হতাশ। তাই আমার প্রবাস জীবনের জমানো টাকা এবং ধার দেনা করে কিস্তি চালিয়ে যাচ্ছি। শিল্প নগরীর অপর উদ্যোক্তা সুন্দরবন পলিমার কারখানার মালিক আঃ সত্তার।
তিনি এখানে প্লট কিনে উৎপাদন শুরু করতে সমস্যা কোথায় জানতে চাইলে বলেন, আমি এখানে প্লাষ্টিক পাইপ তৈরীর কারখানা করতে চাই। এজন্য চায়না থেকে মেশিন আনতে পারছিনা।
কারণ ব্যাংক এলসি নিচ্ছেনা। কিছু না বলে আমাকে মাসের পর মাস ঘুরাচ্ছে। কিন্তু বিসিকের কিস্তি দিতে হচ্ছে। এক কথায় আমার এখানে প্লট নিলেও ব্যাবসা ক্ষেত্রে ব্যাংকের কোন সহযোগিতা পাচ্ছিনা।
এ প্রসঙ্গ নিয়ে ঝালকাঠি ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রধান প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মো. সফিকুল হক জানান, আমারা অবশ্যই শিল্প বিনিয়গে সহায়তা করতে প্রস্তুত। ঝালকাঠি বিসিকে যারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন তাদের অনেকেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো ঐ প্লট সরকারি ভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিস্তির মাধ্যমে প্লটের মূল্য পরিশোধ না করা পর্যন্ত লোন প্রদান করা সম্ভব না।
ঝালকাঠি বিসিক শিল্প নগরীর উপ-ব্যবস্থাপক শাফাউল করিম জানান, সকল প্রকার শর্ত পূরণ করেই উদ্যোক্তারা প্লট নিয়েছে। প্রথম আবেদনের সময় ২০% টাকা জমা দিয়ে ৪ বছরে মোট ১০ কিস্তিতে পুরো টাকা পরিশেধ করার পর ৯৯ বছরের জন্য প্ল্টের মালিক হবেন তারা। এই মূহুর্তে উদ্যোক্তারা প্লটের মালিক না হওয়ায় ব্যাংক লোন পাচ্ছেনা।
তবে তারা কিস্তির পুরো টাকা পরিশোধ করে এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নিয়ে লোন চাইলে ব্যাংক বিবেচনায় নিতে পারে। উদ্যোক্তাদের বরাদ্দ বাতিলের চিঠি প্রসঙ্গে উপব্যবস্থাপক জানান, তারা প্লট বরাদ্দের সব শর্ত মেনেই বরাদ্দ নিয়েছে। তাই এখন বরাদ্দ বাতিলের ক্ষমতা আমাদের নেই। এটা জেলা প্রশাসকের এখতিয়ার। প্লট বরাদ্দ নিয়ে প্রকল্প শুরু না করার কারণ জানতে গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সভা আহ্বান করা হয়ে ছিল। ঐ সভায় ২/৩ জন ছাড়া বাকি উদ্যোক্তারা কেহই আসেনি।