পরিষদ চত্ত্বরে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বরাদ্দকৃত ফোয়ারা (ঝর্ণা) নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিনের তার সরকারি বাসার মধ্যে ফোয়ারা পাম্প নির্মাণ করার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও ইউএনও আলপনা ইয়াসমিনের বেপরোয়া আচরণ, সেচ্ছাচারিতা, কাবিটা ও টিআর এর আরো তিনটি প্রকল্পের টাকা হরিলুটের নানান অভিযোগ উঠেছে ইউএনও আলপনা ইয়াসমিনসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
২০২০-২১ অর্থবছরে উপজেলা পরিষদওয়ারী ৩য় পর্যায়ে সংশোধিত প্রকল্পে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) এর আওতায় তিনটি ও গ্রামীণ অবকাঠানো সংস্কার (কাবিটা) কর্মসূচীর আওতায় একটি বরাদ্দ দেয়া হয়।
গত ২০২১ সালে বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন যোগদানের পর থেকে তার বিরুদ্ধে সেচ্ছাচারিতা, অশালীন ও বেপরোয়া আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন উপজেলাবাসি। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করারও অভিযোগে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ইউএনওর অপসারণ দাবিতে ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর ৩০ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগপত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠান। এছাড়া জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অনুলিপি পাঠানো হয়েছে। ইউএনও’র দ্রুত বদলির দাবি জানান সুধীজনরা।
এ নিয়ে দেশের স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ডয়চে ভেলে সংবাদ প্রকাশ হয়। ডয়চে ভেলে এর সূত্রে ধরে ২২ সালে ২৫ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘ব্যবস্থা না নেওয়ায় বেপরোয়া ইউএনওরা’ শিরোনামে একটি সংবাদও প্রকাশ হয়। সেই সংবাদে অসদাচরণের ‘ইউএনও আলপনা ইয়াসমিন’ এর নাম উঠে আসে।
বদলগাছী উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও যুদ্ধকালীন কমান্ডার ডিএম এনামুল হক বলেন, তিনি (ইউএনও আলপনা ইয়াসমিন) উপজেলায় যোগদানের পর থেকে সাধারণ মানুষ, সম্মানিত ব্যক্তিসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অসাদাচারণ করেন। উপজেলাবাসিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করেন না। এর আগে এসব বিষয়ে ইউএনওর সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তিনি সংশোধন হননি। তার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে দ্রুত বদলী ও শাস্তির জন্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ পাঠানো হয়।
ডিএম এনামুল হক ক্ষোভের সাথে আরো বলেন, অসদাচারণের পর রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের সাথে দেখা করার পরও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ‘আমাদের দূর্ভাগ্যে আর ইউএনও’র সৌভাগ্য’ বলে মন্তব্য করে আলপনা ইয়াসমিনের দ্রুত বদলীর দাবি করেন।
জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থ বছরে জেলা ত্রাণ ও পূণবার্সণ কর্তকর্তা কামরুল আহসানের স্বাক্ষরিত বদলগাছী উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠানো সংস্কার (কাবিটা) প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯২০ টাকা উপজেলার কার্ত্তিকাহার সরদার পাড়া পাকা রাস্তার ধারে জামে মসজিদের গর্ত ভরাটে বরাদ্দ দেয়া হয়। এই বরাদ্দকৃত কাজ ৯ মে ২১ সালে এই প্রকল্প সংশোধন করে উপজেলা পরিষদের ভিতরে মাটি ভরাট ও সংস্কারের অনুমোদন করা হয়।
একই অর্থবছরে টিআর প্রকল্পের আওতায় তিনটি প্রকল্পে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। উপজেলার ভাতশাইল ইটাকড়া বিউটির বাড়ীর পার্শে¦ রাস্তায় প্যালাসাইডিং করণে ৫০ হাজার টাকা, উপজেলা পরিষদের ভিতরে পানির ফোয়ারা নির্মাণে ৮০ হাজার টাকা এবং বিলাশবাড়ী ইউনিয়নের চকগোপি ব্রিজ ও হাজিপুর দক্ষিণ মাঠের ব্রীজের মেরামত/সংস্কারে ৫০ হাজার টাকা। পরবর্তীতে গত ১১ মে ২১ সালে এই তিনটি প্রকল্প সংশোধন করে উপজেলা পরিষদের বাসাবাড়ির আংগিনায় মাটি ভরাট, পরিষদের ভিতরে ফোয়ারা (ঝর্ণা) পাম্প স্থাপন এবং ফোয়ারার (ঝর্ণা) চারপাশে ইটসোলিং করণ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই চারটি প্রকল্প ৯ মে এবং ১১ মে অর্থাৎ দুই দিনের ব্যবধানের সংশোধিত অনুমোদন করেন জেলা ত্রাণ ও পুনবার্সণ তৎকালিন কর্তকর্তা কামরুল আহসান। এরপর উপজেলা পরিষদের ভিতরে ফোয়ারা পাম্প স্থাপনের বরাদ্দ থাকলেও ইউএনও আলপনা ইয়াসমিনের সরকারি বাসার প্রাচীরের মধ্যে ফোয়ারা পাম্প নির্মাণ করা হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশে উপজেলা পরিষদের মধ্যে বসবাসরত একাধিক ব্যক্তি এবং স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্ন উপজেলা পরিষদের মধ্যে সৌন্দর্য বর্ধনে সরকারি ভাবে পরিষদ চত্ত্বরে ফোয়ারা স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ইউএনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার সরকারি বাসার প্রাচীরের মধ্যে এই ফোয়ারা স্থাপন করেছেন। তারা আরো অভিযোগ করে বলেন, উপজেলা পরিষদের বাসাবাড়ির আংগিনায় মাটি ভরাট ও পরিষদের মধ্যে মাটি ভরাটের দুটি প্রকল্পে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৯২০ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। উপজেলার দু’টি প্রত্যন্ত এলাকার কাজের বরাদ্দ থাকলেও এই অর্থ আতœসাতের লক্ষ্যে মাত্র দুই দিনের ব্যবধানের সংশোধিত অনুমোদন পরিষদের মধ্যে এই প্রকল্পগুলো বরাদ্দ করা হয়। এবং সে দুটি প্রকল্পের কাজ না করেই লুটপাট করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া অপর একটি প্রকল্পের নাম মাত্র কাজ করে ইউএনও আলপনা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্টরা বরাদ্দে টাকা হরিলুট করেছেন।
বদলগাছীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত এবং বর্তমান নওগাঁ সদর উপজলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মাহবুবুর রহমান জানান, এলাকায় উন্নয়নে উপজেলার গ্রাম এলাকায় দু’টি প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো। পরে ইউএনও আলপনা ইয়াসমিন তার ক্ষমতা বলে ইচ্ছে মতো উপজেলা পরিষদের মধ্যে প্রকল্প দু’টির বরাদ্দ নিয়ে নেন। এরপর ওই প্রকল্পে কাকে কাকে সভাপতিসহ অন্য সদস্য করেছেন তা আমি জানি না। শুধুমাত্র পিআইও হিসেবে আমার স্বাক্ষর চেয়েছেন আমি দিয়ে দিয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা ইউএনও আলপনা ইয়াসমিন কি করেছেন তাও আমি জানি না।
মাহবুবুর রহমান আরো জানান, যেখানে প্রকল্প নির্ধারণ করেছেন সেখানে মাটি ফেলার জন্যে আমাকে অনুরোধ করলে আমি অফিসের কার্যসহকারি সোহেল হোসেনকে দিয়ে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১০ হাজার টাকার ১০ ট্রাক্টর মাটি ব্যবস্থা করে দিয়েছে আমি। সেই মাটির ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বললে আমি আমার পকেট থেকে ব্যক্তিগত ভাবে পরিশোধ করেছি। তিনি (ইউএনও) আমাকে সেই ১০ হাজার টাকা
আজও দেননি।
বরাদ্দের টাকা হরিলুটের সাথে জড়িত নয় দাবি করে নওগাঁর তৎকালিন জেলা ত্রাণ ও পুনবার্সণ কর্তকর্তা বর্তমানে ঢাকায় প্রধান অফিসে ডেপুটি প্রজেক্ট ডেরেক্টর কামরুল আহসান জানান, এক বছর আগে বদলী হয়ে আসায় বিস্তারিত মনে নেই। অপর প্রশ্নে তিনি আরো বলেন, পরিষদের মধ্যে ফোয়ারা পাম্প স্থাপনের সরকারি নির্দেশণা থাকার পরও যদি (ইউএনও) তা না করে সরকারি বাসার মধ্যে স্থাপন করেন সেটি আইন সম্মত না।
বদলগাছী উপজেলা পরিষদ চেয়রম্যান শামছুল আলম বলেন, আমরা জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরও আমাদের কোন পাত্তা দেন না (ইউএনও)। তিনি কি করেন না করেন তিনিই জানেন।
বদলগাছী উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, উপজেলার সৌন্দর্য বর্ধনে পরিষদ চত্ত্বরে ফোয়ারা নির্মাণ করতে হবে সেটার কোন নিয়ম নেই। যে কোন স্থানে করা যায়। অপর প্রশ্নে (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন কাজ হয়েছে কি না সরেজমিনে দেখে আসতে বলেন।
নওগাঁ জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান জানান, ফোয়ারা পাম্প স্থাপন কোথায় করা হয় সেটির সঠিক নিয়ম জানা নেই। অপর প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়গুলোর খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।