“মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই, ইহার চেয়ে নামটি মধুর ত্রিভূবনে নাই।”
আমার শৈশব আর কৈশরের দিনগুলো কেটেছে মা-বাবার যত্ন ভালোবাসায়। সেই সুখ স্মৃতির মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশটুকু হলো আমার মাকে, যিনি ছিলেন আমার ছোখে অবাক বিষ্ময়। ফর্সাবরণ সেই মায়ের চারিদিকে থাকতো ব্যক্তিত্বের সুকঠিন বর্ম আাঁটা। তাই আমরা ভাই বোনেরা তাঁকে কেন জানি না ভয় করতাম।
ভক্তি আর ভালোবাসা চাপা পড়ে যেত তার আড়ালে। প্রাণ খোলা বাবার কাছে ছিল সব যত আবদার। কিন্তু টের পেতাম মায়ের ফল্গুধারারর মত বহমান ভালোবাসা যা ছিল সুসৃঙ্খল পরিমিতবোধের আবরণে সুবিন্যস্ত। আজ বয়সের ভারে নত সেই মাকে যখন দেখি সন্তানদের কল্যাণকামনা আর স্নেহ-ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে সদা ব্যাকুল, উদগ্র, উন্মুখ, তখন মনে হয় বুঝি মাকে চিনতে ভুল করেছি সরাজীবন। হায় আর একবার যদি সুযোগ পেতাম সংশোধনের!
প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ কম থাকার দরুণ আমার মা কোন ডিগ্রী অর্জন করতে পারেননি। ছেলেবেলায় ভালো ছিলাম বলে মা এবং বাবা বিশেষ করে মায়ের প্রিয় পাত্র ছিলাম। সফলতার সাথে শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছি যশ, সুনাম আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। এসব কিছুর পেছনে রয়েছে মায়ের অনিঃশেষ ভালোবাসা আর মঙ্গলাকাঙ্খা-যা আজও আমাকে ছুঁয়ে যায় অবিরত আজও তিনি আমাদের মধ্যে আছেন ভোরের সূর্যকিরণ হয়ে; দিনান্তরে গোধূলী আর চন্দ্রালোকিত রাত্রির মধুরিমা হয়ে; জীবন অমোঘ অথচ অনুল্লেখ্য।
মাকে কোনদিন প্রশংসা করিনি। তাঁর বড় কিংবা ছোট কোন অবদানকে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন মনে করিনি। কোনভাবে আনন্দিত করার কথা ভাবিনি কখনো। নিজের জীবনকে সাজানো বাগানের মত সুবিন্যস্ত করে তুলতে গিয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি ছকবাঁধা দিনপঞ্জির শৃঙ্খলে। মায়ের স্নেহের ডাক উপক্ষা করেছি দিনের পর দিন। দিতে পারি নি একটু সময়। জানি মায়ের লোভ নেই কোন সম্পদ বা বিত্ত-বেসাতে।
নয় কোন উপহার উপঢৌকনে। মায়ের চাওয়া হলো নিছক মমতা আর ভালোবাসার মোড়কে উন্মোচন করে আপন অন্তরকে দীর্ঘদিন অদেখা সন্তানের কাছে সামান্য সময়ের জন্য তুলে ধরা। মা তো জানেন না সারা বিশ্বে একদিন পালিত হচ্ছে মা দিবস-সন্তানের জন্য তার আকুলতা যে, সর্বক্ষণের, সারাজীবনের। আমারা সন্তানরা মায়ের জন্য ব্যয় করার মত সময় খুঁজে পাই না অথচ তিনি তার গোটা জীবনের নির্যাস দিয়ে রচনা করেছেন আমার বা আমাদের পৃথিবী। তার সেই অমূল্য সম্পদকে অবলম্বন করেই আমাদের বেঁচে থাক, বেড়ে ওঠা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা।
তাই জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ব্যর্থতা আর অতৃপ্তির তেপান্তর পেরিয়ে ক্ষণিকের জন্য মায়ের কাছে ফিরে আসা যেন এক শান্ত শীতল তরুচ্ছায়াতলে ফিরে আসা; প্রাণের টানে থমকে যাওয়া। মাগো তোমায় দিতে পারি না কিছুই।
তোমার কাছে বসে অলস বেলায় শুনতে পারি না, জানতে পারি না তোমার ছোট-ছোট আনন্দ-বেদনার কথা। স্বার্থপর জগতে সৃঙ্খলিত কারাগারে বাঁধা রয়েছি যে আমরা। তোমার সন্তানেরা । তবু তারই মধ্যে চরম দুঃখ কিংবা পরম আনন্দের দিনে চকিত মনের কোণে উঁকি দেয় তোমার মুখ। মনে পড়ে তোমার কথা, অনুভবে সজীব হয়ে ওঠো তুমি-ভালোলাগায়, ভালোবাসায়।