কাদারি প্রতিষ্ঠানসহ রেলের সংশ্লিষ্ট অনেকে মিলে অনিয়মের উদ্দেশ্যে সংস্কারের সময় অচল অবস্থায় থাকা রেলপথটির লুপ লাইন কমিয়ে এনেছে। রেলের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তাসহ ষোলশহর-দোহাজারী সেকশনের একাধিক স্টেশনমাস্টার বলছেন, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেলপথ নতুন করে নির্মাণ হলেও ষোলশহর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার রেলপথ পুরনো।
২০১৮ সালে শেষ হওয়া প্রকল্পের মাধ্যমে রেলপথটি সংস্কারকালে একটি পটিয়া স্টেশনের লুপ লাইন কমিয়ে ফেলা হয়েছে। একই ঘটনা অন্যত্র ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথকে ঝুঁকিহীন করতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুরনো লাইনটি নতুন করে সংস্কারের বিকল্প নেই।
মূল রেলপথ থেকে একটি শাখা লাইন বের হয়ে তা কিছুদূর গিয়ে আবার মিলে গেলে সেটিকে বলা হয় লুপ লাইন। স্টেশন এলাকায় ক্রসিংয়ের সময় দুর্ঘটনা এড়ানোর পাশাপাশি ইঞ্জিন পরিবর্তনসহ নানা কাজে এ লাইন ব্যবহার হয়। সারা দেশের বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন অপেক্ষমাণ রাখতে অন্তত একটি ৭৫০ মিটার (পৌনে এক কিলোমিটার) দৈর্ঘ্যের লুপ লাইন রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
কিন্তু অবাক করার মত বিষয়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের পটিয়া রেলওয়ে স্টেশনে লুপ লাইনের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা হয়েছে ৩৬৫ মিটারে! যদিও রেলের পরিবহন বিভাগের ওয়ার্কিং টাইম টেবিলে লুপ লাইনের দৈর্ঘ্য দেয়া আছে ৪৮৭ দশমিক ৮৬ মিটার। এ বিষয়ে বিভাগটির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ২০১৫-১৮ সালে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথ সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় লুপ লাইনটির দৈর্ঘ্য কমিয়ে ফেলা হয়।
রেলের নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, রেলওয়ের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীসহ প্রকৌশল বিভাগ ও পরিবহন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ২০১৫ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ১৭ আগস্টের মধ্যে লুপ লাইন কমিয়ে করা নতুন নকশায় স্বাক্ষর করেছেন। যদিও পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, এ বিষয়ে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি।
ফলে তাদের ওয়ার্কিং টাইম টেবিলে (ডব্লিউটিটি) প্রতি বছর লুপ লাইনের পুরনো দৈর্ঘ্যই ছাপানো হচ্ছে। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো কোনো স্টেশনেই লুপ লাইনের আকার ছোট করার কোনো যুক্তিই নেই, বরং ট্রেনের দৈর্ঘ্য ও কোচ সংখ্যা বৃদ্ধি বিবেচনায় অনেক স্টেশনেই এখন তা নতুন করে বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। পটিয়া স্টেশনের ছোট আকৃতির লুপ লাইন বেশি কোচ ও দৈর্ঘ্যসংবলিত ট্রেন ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। এতে রেলপথটিতে এখন বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রধান ট্রেন কন্ট্রোল অফিসের কর্মকর্তা ও স্টেশনমাস্টাররা বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেনের ক্রসিং সম্পন্ন করেন ডব্লিউটিটির তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। ডব্লিউটিটিতে লুপ লাইনের দৈর্ঘ্য পরিবর্তনের তথ্য না থাকায় এরই মধ্যে এক দফা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে দেখা গেছে। গত ২৬ এপ্রিল কক্সবাজারমুখী পর্যটক এক্সপ্রেস ও ঢাকামুখী কক্সবাজার এক্সপ্রেস একই সময়ে পটিয়া স্টেশনে ক্রসিংয়ের জন্য মুখোমুখি হয়। ওই সময়ে মূল লাইন দিয়ে ঢাকামুখী কক্সবাজার এক্সপ্রেস পটিয়া স্টেশন অতিক্রমের সিগন্যাল দেয়া হয়।
আর পর্যটক এক্সপ্রেসকে প্রবেশ করানো হয় স্টেশনের লুপ লাইনে কিন্তু লুপ লাইনের দৈর্ঘ্য ট্রেনের তুলনায় ছোট হওয়ায় পেছনের তিনটি বগি মূল লাইনেই থেকে যায়। এ অবস্থায় ডেঞ্জার সিগন্যাল পাওয়ায় কক্সবাজার এক্সপ্রেসকে হোম সিগন্যালে আটকে রাখে ট্রেনটির লোকোমাস্টার। সে সময় দুটি ট্রেনের ক্রসিং সম্পন্ন করতে না পারায় কক্সবাজার এক্সপ্রেসকে প্রায় ৫৫ মিনিট সময় নিয়ে ব্যাক ইঞ্জিনে উল্টোপথে ট্রেন চালিয়ে দোহাজারী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগ পর্যন্ত উভয় ট্রেনের ক্রসিং করানো সম্ভব হয়নি। রেলওয়ের ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পটিয়া স্টেশনের লুপ লাইন সংক্রান্ত ঘটনার পর বিভাগীয় ট্রাফিক অফিসার আনিসুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে। কমিটি এরই মধ্যে তথ্য-উপাত্ত ও মাঠ পর্যায়ের তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তদন্তের বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তদন্ত কমিটির কোনো সদস্যই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
রেলের নকশা ও নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথটি অচল অবস্থায় ছিল দীর্ঘদিন। রেলপথটি নির্মাণের সময়কার ওয়ার্কিং রুল ডায়াগ্রাম অনুযায়ী পটিয়া স্টেশনের লুপ লাইনের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৬০০ ফুট বা ৪৮৭ দশমিক ৮৬ মিটার কিন্তু ২৬ এপ্রিলের ঘটনার পর লুপ লাইনটির দৈর্ঘ্য মেপে পাওয়া গেছে ৩৬৫ মিটার।
সে অনুযায়ী লুপ লাইনটির দৈর্ঘ্য কমানো হয়েছে প্রায় ১২২ দশমিক ৮৬ মিটার। পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সন্দেহ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে মিলে অনিয়মের উদ্দেশ্যে সংস্কারের সময় অচল অবস্থায় থাকা রেলপথটির লুপ লাইন কমিয়ে এনেছে।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ওয়েবসাইট এর কোনো লেখা, ছবি অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ