চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে সৌন্দর্য, বৈচিত্র্য ও বিশালতায় সমৃদ্ধ। ভূ-প্রাকৃতিক রূপে যেমন এর বিচিত্রতা তেমনি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের ঐশ্বর্যমণ্ডিত বৈশিষ্ট্য। এ বিভাগের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর সহ প্রায় সকল জেলায় রয়েছে নিজ নিজ ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য। নীচে জেলা ভিত্তিক এ বিভাগের ঐতিহ্যসমূহ উল্লেখ করা হল
চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন।
জানা ইতিহাসের শুরু থেকে চট্টগ্রামে আরাকানী মঘীদের প্রভাব লক্ষনীয়। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সে সময় এখানকার রাজারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হওয়ায় তার প্রভাব ও যথেষ্ট। সুলতানি, আফগান এবং মোগল আমলে ও আরাকানীদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত মঘীদের প্রভাব বিলুপ্ত হয়নি।
এছাড়া চট্টগ্রামের মানুষ আতিথেয়তার জন্য দেশ বিখ্যাত। চট্টগ্রামের বর্তমান সংস্কৃতির উন্মেষ হয় ১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক ধানোৎপাদন ও বন্টনে পদ্ধতিগত আমূল পরিবর্তন হয়। অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামে ও একটি নতুন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। নতুন এরই ফাঁকে ইংরেজরা প্রচলনা করে ইংরেজি শিক্ষা।
মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ইতিহাস সমৃদ্ধ। শেফালী ঘোষ এবং শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবকে বলা হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞি। মাইজভান্ডারী গান ও কবিয়াল গান চট্টগ্রামের অন্যতম ঐতিহ্য। কবিয়াল রমেশ শীল একজন বিখ্যাত কিংবদন্তি শিল্পী। জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস, এল আর বি, রেঁনেসা, নগরবাউল এর জন্ম চট্টগ্রাম থেকেই।
আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, রবি চৌধুরী, নাকিব খান, পার্থ বডুয়া, সন্দিপন, নাসিম আলি খান, মিলা ইসলাম চট্টগ্রামের সন্তান। নৃত্যে চট্টগ্রামের ইতিহাস মনে রখার মত। রুনু বিশ্বাস জাতীয় পর্যায়ে বিখ্যাত নৃত্যগুরু। চট্টগ্রামের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন হল দৃষ্টি চট্টগ্রাম বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা, আলাউদ্দিন ললিতকলা একাডেমি, প্রাপন একাডেমি, উদিচি, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, ফু্লকি, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা, রক্তকরবী, আর্য সঙ্গীত, সঙ্গীত পরিষদ। মডেল তারকা নোবেল, মৌটুসি, শ্রাবস্তীর চট্টগ্রামে জন্ম ।
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমি, মুসলিম হল, থিয়েটার ইন্সটিটিউট। বৈচিত্রময়ী চট্টগ্রামের নামও বৈচিত্রে ভরা। খ্রিষ্টীয় দশক শতকের আগে চট্টগ্রাম নামের অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ চট্টগ্রাম নামের কোন উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই দেখা যায় যে, সুপ্রাচীনকাল থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিব্রাজক, ভৌগোলিক এবং পন্ডিতগণের লিখিত বিবরণে, অঙ্কিত মানচিত্রে, এখানকার শাসক গৌড়ের সুলতান ও রাজাদের মুদ্রায় চট্টগ্রামকে বহু নামে খ্যাত করেছিলেন।
এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৪৮টি নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -সুহ্মদেশ, ক্লীং, রম্যভূমি,চাতগাঁও, চট্টল, চৈত্যগ্রাম, সপ্তগ্রাম, চট্টলা, চক্রশালা, শ্রীচট্টল,চাটিগাঁ, পুস্পপুর, চিতাগঞ্জ, চাটিগ্রাম ইত্যাদি। কিন্তু কোন নামের সঙ্গে পাঁচজন একমত হন না। সে সব নাম থেকে চট্টগ্রামের নাম উৎপত্তির সম্ভাব্য ও চট্টগ্রামের নামের সঙ্গে ধ্বনিমিলযুক্ত তেরটি নামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো। চৈত্যগ্রাম:- চট্টগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিমত এই যে, প্রাচীনকালে এখানে অসংখ্য বৌদ্ধ চৈত্য অবস্থিত ছিল বলে এ স্থানের নাম হয় চৈত্যগ্রাম। চৈত্য অর্থ বৌদ্ধমন্দির কেয়াং বা বিহার। এই চৈত্যের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয় বলে চৈত্যগ্রাম নামের উদ্ভব হয়।
পরবর্তীকালে চৈত্যগ্রাম নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়। চতুঃগ্রাম:ব্রিটিশ আমলের গেজেটিয়ার লেখক ও’মলি সাহেবের মতে,সংস্কৃত চতুঃগ্রাম শব্দ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। চতুঃ অর্থ চার।
চতুঃ শব্দের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয়ে চতুঃগ্রাম হয়। চতুঃ-গ্রাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়। চট্টল:চট্টগ্রামের তান্ত্রিক ও পৌরাণিক নাম ছিল চট্টল। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণগ্রন্থে চট্টল নামের উল্লেখ দেখা যায়।