রিয়াদুন্নবী রিয়াদ নিজস্ব প্রতিবেদক:
রংপুরের গঙ্গাচড়ায় পিয়ন পদে মাত্র ১৫-২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে ভূপতি চন্দ্র মহন্ত (৫০) কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তিনি বাবার পৈত্রিক সম্পতি হিসেবে পেয়েছিলেন মাত্র ৪ শতক বসতবাড়ি। তার অন্য তিন ভাইও বাবার বসতবাড়ির সমান ভাগ পান। দুই ভাই মারা গেছেন। ভাইয়েরা এক শতকও জমি কিনতে না পারলেও ভূপতি মহন্ত কিনেছেন ২০ থেকে ২৫ দোন (২২ শতকে দোন) আবাদি জমি। গ্রামে নির্মাণ করেছেন বিলাস বহুল দু'টি বাড়ি। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ৪ কোটি টাকায় কিনেছেন রংপুর নগরীতে সাত শতক এবং কোটি টাকায় গঙ্গাচড়া শহরে ৮ শতক জমি। এ ছাড়াও তিনি ১০ থেকে ১২ দোন আবাদি জমি বর্গা নিয়েছেন। তিনি শ্বশুর বাড়ি এলাকায়ও কিনেছেন অবাদি জমি। আছে স্ত্রীর নামে ব্যাংক ব্যালেন্সও। পিয়ন পদে এ সামান্য বেতনে চাকরি করে তাঁর এত সম্পদ অর্জন নিয়ে বিস্মিত হয়েছেন এলাকার মানুষ।জানা গেছে, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার ভূপতি মহন্ত'র।বড় ছেলে শুভ চন্দ্র মহন্ত এসএসসি পাশ করে আর কলেজে ভর্তি হয়নি। দ্বিতীয় ছেলে সজিব চন্দ্র মহন্ত একটি বিশ্ববি দ্যালয়ে অর্নাসের তৃতীয়বর্ষে অধ্যায়নরত। ২০-২৫ বছর আগে ভূপতি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে পিয়ন পদে চাকরি পান। বর্তমানে তিনি গঙ্গাচড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে পিয়ন পদে কর্মরত আছেন।গত রোববার সরেজমিনে তার গ্রাম গঙ্গাচড়া উপজেলার চেংমারী কুরিয়ার মোড় এলাকায় গিয়ে তাঁর এসব সম্পতির হিসাব পাওয়া যায়। ওই রাস্তার পার্শ্বে ভুপতির বাড়ি। দুর থেকে দেখা যায়, সবুজ রঙ্গের একতলা বিশিষ্ট বাড়ি। তার সেই বাড়ির দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে দেখা যায়, পাশেই আরেকটি দ্বিতলভবন বাড়ি। সেই বাড়িটি বাইর ও ভিতরের ওয়াল পুরোই টাইলস লাগানো। এলাকাবাসী বলছেন, তার গ্রামে একটি বাড়িই যথষ্ট । কিন্তু সম্প্রতি তিনি কোটি টাকা খরচ করে বাড়ির ভিতরে আরেকটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তবে তার বাড়ির পাশে থাকেন ছোট ভাই ডালিম মহন্ত। তার বাড়ি টিন দিয়ে ঘেরা। ডালিমের স্ত্রী ববিতা রানী বলেন,'আমার স্বামী চানাচুর বিক্রি করে সংসার চালান। তাই এক শতকও জমি কিনতে পারে নাই। আর আমার ভাশুর ভূপতি ভুমি অফিসে চাকরি করেন। তার অনেক টাকা। তাই তিনি প্রতি বছর জমি কিনছেন।'প্রতিবেশী সোলায়মান বলেন, 'ভূপতির বাবার বেশ কিছু সম্পদ ছিল। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার আগেই সব বিক্রি করে গেছেন। ভূপতি পৈত্রিক সূত্রে ৪ শতক বসতবাড়ি পেয়েছেন। তিনি চাকরি করে ২০ দোনের ওপর আবাদি জমি কিনেছেন। বন্ধক নিয়েছেন অনেক আবাদি জমি।' সোলায়মান আরও বলেন, 'শুনেছি তিনি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে পিয়ন পদে চাকরি করেন। তার সম্পদ কেনা দেখে আমি মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে যাই। আসলে তার বেতন কত? এই পদে চাকরি করে কি এত টাকার সম্পদ করা সম্ভব!এলাকার নুর ইসলাম বলেন, 'ভূপতি এলাকায় যত জমি ক্রয় করেছেন তার হিসাব দেওয়া অসম্ভব। প্রতি বছরেই তিনি জমি কিনছেন। অথচ তার ভাই, ভাতিজারা ভাত পাচ্ছেন না।'খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি এলাকায় এবং শ্বশুর বাড়িতে আবাদি জমি কেনার পাশাপাশি সম্প্রতি গঙ্গাচড়া শহরের মডেল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট সংলগ্ন ৮ শতক এবং রংপুর নগরীর লালকুটির মোড়ে (মন্দির সংলগ্ন) ৭ শতক জমি ক্রয় করেন।এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গঙ্গাচড়ায় শহরের ওই ৮ শতক জায়গার মূল্য প্রায় কোটি টাকা এবং রংপুর নগরীর লালকুটি এলাকার ৭ শতক জমিটির মূল্য ৪ কোটি টাকার ওপর।তবে তার একের পর এক মূল্যবান সম্পতি কেনা নিয়ে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। তবে তার এই সব জমি ও বাড়ি করার আয়ের উৎস নিয়ে মাঠে নামেন এ প্রতিবেদক। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, 'ভূপতি চন্দ্র মহন্ত গঙ্গাচড়া ভূমি অফিসে দীর্ঘ বছর ধরে পিয়ন পদে রয়েছেন। সেখানে সেবা নিতে আসা লোকজন তাকেই ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা হিসেবে চিনেন। তার চা, পান ও অফিস পরিস্কার রাখা কাজ হলেও তিনি অফিসিয়াল যাবতীয় কাজ করেন। জমির নামজারি করে দেওয়ার নামে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। এছাড়াও কারও জমির কাগজপত্রে ভেজাল থাকলে সেটি নিয়েও তিনি করেন দেনদরবার। হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।উপজেলার পশ্চিম চেংমারী গ্রামের সুজন মিয়া (৫৫), মেরাজুল ইসলাম (৭০) ও মমতাজ বেগম (৭৫) ৩৩ শতক জমির ওপর বহু বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। সুজন মিয়া বলেন, স্বাধীনতার আগে বাপ দাদা এই জমি ডা. আলিমুদ্দিনের কাছ থেকে কিনে বসবাস শুরু করেন। জমি লিখে দেওয়ার আগে আলিমুদ্দিন মারা যান। তার ছেলে আজিজুল ইসলাম লন্ডন প্রবাসী। সুজন মিয়া অভিযোগ করে বলেন, 'সম্প্রতি ভূমি অফিসের পিয়ন বাড়িতে এসে বলেন এই জমি আমাকেদেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন লন্ডন প্রবাসী আজিজুল ইসলাম। তিনি দেশে আসছেন, পাঁচ লাখ টাকা দেন তোমাকে ১১ শতক জমি লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেছি। আমি পিয়নকে পাঁচ লাখ টাকা দেই। কিন্তু জমি লিখে দেয়নি। মমতাজ বেগম অভিযোগ করে বলেন, 'জমি লিখে দিতে আমার কাছেও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন পিয়ন। কিন্তু আমার স্বামী ও ছেলে সন্তান না থাকায় তার দাবিকৃত টাকা দিতে পারি নাই। তবে ৭০ হাজার টাকা সুদের ওপর এনে পিয়নকে দিয়েছি। কিন্তু জমি লিখে দেননি।' মমতাজ বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, 'জমির মালিক লন্ডণ প্রবাসী। তাকে কোনোদিনও দেখিনি। কিন্তু সেই জমি লিখে দেওয়ার কথা বলে ৭০ হাজার টাকা নেওয়ার পর আবারও টাকা দাবি করছেন পিয়ন। আমি কোথায় পাই এত টাকা?' মেরাজুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, 'আমার কাছ থেকেও ৭৫ হাজার টাকা নিয়েছেন পিয়ন। এখন আবারও টাকা দাবি করছেন।' শুধু সুজন, মমতাজ ও মেরাজুলের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা নেননি। ওই পিয়ন এলাকার আরও বেশ কিছু মানুষের কাছ থেকে ওই লন্ডণ প্রবাসীর আবাদি জমি লিখে দেওয়ার কথা বলে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এলাকার মিঠু সরকার, হারুন, ইমরান, মনোয়ার নবীর হোসেন অভিযোগ করে বলেন, 'ওই পিয়ন লন্ডন প্রবাসীর আবাদি জমি লিখে দেওয়ার কথা বলে আমাদেরকে কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন। পরে জমি লিখে দিতে না পারায় চার লাখ টাকা ফেরত দেন। বাকী টাকা ফেরত চাইলে উল্টা চাঁদাবাজি মামলার হুমকি দেন পিয়ন।' কয়েক কোটি টাকার সম্পদ অর্জনেরবিষয়ে জানতে চাইলে পিয়নের স্ত্রী কৃষ্ণ রানী মহন্ত বলেন, 'এটা আমি জানি না। আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন।' এক পর্যায়ে কৃষ্ণ রানী মহন্ত বলেন, 'আমরা ভালো খাচ্ছি এলাকার মানুষের সহ্য হচ্ছে না। এখন আমাদের পেছনে সাংবাদিক লাগিয়ে দিয়েছে।'সম্পদ অর্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে পিয়ন ভূপতি চন্দ্র মহন্ত কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'কোন টাকায় সম্পদ অর্জন করেছি, আপনাকে কেন জানাবো? আপনি আমার বাড়ির ছবি কেন তুলেছেন? এখন আমি আপনাকে কী করতে পারি, জানেন! আপনার চেয়েও বড় সাংবাদিক আমার ছেলে। আপনি এখন থেকে যান, আমি দুর্নীতি করে সম্পদ অর্জন করেছি, যত পারেন আমার বিরুদ্ধে পত্রিকায় নিউজ লিখেন।'গঙ্গাচড়া ইউনিয়ন সহকারি ভূমি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, 'আমার এখানে আসার বেশিদিন হয়নি। আমি আসার পর এখানে কোনো দুর্নীতি হয় না।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'জীবনে চাকরি করে আমি কিছু করতে পারলাম না। অবশ্যই পিয়নের সম্পদের তদন্ত হওয়া দরকার।'গঙ্গাচড়া উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) জান্নাতুন ফেরদৌস উর্মি বলেন, 'আমি সম্প্রতি এ উপজেলায় যোগদান করেছি। ওই পিয়নের বিরুদ্ধে কোনো রকমের দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে আমাকে দেন। আমি বিষয়টি দেখবো।'গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ তামান্না বলেন, 'ওই পিয়ন দুর্নীতিগ্রস্থ। তার বিরুদ্ধে আগে বহুবার নানা অভিযোগ শুনেছি। কিন্ত লিখিত অভিযোগ না পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'পিয়ন পদে চাকরি করে এত টাকার সম্পদ অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।'রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আব্দুল মান্নান বলেন, 'কোন টাকায় ওই পিয়ন এত সম্পদের মালিক হলেন তা তদন্ত করা হবে।'
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ওয়েবসাইট এর কোনো লেখা, ছবি অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ