চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে বছরের পর বছর অনাবাদি হয়ে পড়ে রয়েছে শত শত একর ফসলি জমি। জলাবদ্ধতা, পানি চলাচলের পথ না রেখে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, মিল কারখানা স্থাপন, জমির উর্বরতা হ্রাস ও খাল দখল দূষণের কারণে অধিকাংশ জমি চাষাবাদের গ্রহণ যোগ্যতা হারানোর ফলে দিন দিন বাড়ছে অনাবাদি জমির সংখ্যা। বোয়ালখালী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে,উপজেলাতে নীট আবাদি জমির পরিমাণ ১৬ হাজার ৯২০একর। এর মধ্যে এক ফসলি জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৫৩২ দশমিক ৪০ একর, দুই ফসলি ১২ হাজার ১৫২ দশমিক ৪০ ও তিন ফসলি ১ হাজার ১৩৬ দশমিক ২০ একর।
তবে সম্প্রতি কৃষি অফিসের জরিপে দেখা গেছে, জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত আবাসন, মিল কারখানা স্থাপন, জমির উর্বরতা হ্রাস ও খাল দখল দূষণের কারণে অনাবাদি হয়ে পড়েছে প্রায় ১হাজার ৮৫২ একর জমি। অনাবাদি এসব জমিতে আমন মৌসুমে ২/৩ হাজার হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হতো।
এছাড়া রবি শস্য বা সবজি উৎপাদন হতো অন্তত ৫ হাজার মেট্রিক টন। ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর উপজেলা ও পৌরসভার পশ্চিম গোমদন্ডী, কধুরখীল, শাকপুরা সারোয়াতলি, পোপাদিয়া, চরণদ্বীপ খরনদ্বীপ, আমুচিয়া ও করলডেঙ্গার ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জমিতে কচুরিপানা আর আগাছায় ভরপুর হয়ে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে এসব ফসলি জমি। পোপাদিয়া ইউনিয়নের চড়ই বিলের কৃষক নাজিম, আনোয়ার,লোকমান, হরিপদ, মোহাম্মদ শাহ আলম ,বুলবুল মহাজন, দীপক মহাজন,স্বপন বিশ্বাস, মৃদুল চৌধুরী, ঝুন্টু চৌধুরীসহ অনেকেই বলেন, প্রভাবশালীরা জমির উপর অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, পুকুর খনন করে বাঁধ নির্মাণ, খাল ভরাট করে পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ করে দেওয়ায় বিগত ১০ / ১২ বছর ধরে ১২০ একর জমি অনাবাদি হয়ে গেছে । এতে অন্তত ৫শ কৃষককে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। আনোযার বলেন, এসব বিলে এক সময় প্রচুর ধান হতো।
১৫ বছর আগেও আমন ধানের পরে প্রচুর শীতকালীন শাক সবজিতে ভরে উঠতো এসব বিল। সারোয়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা জামাল, সিরাজ,মামুন সহ আরো অনেকের একই অভিযোগ জলবদ্ধতার, লবনাক্ত পানি, অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মানের ফলে চাষাবাদ ব্যবহত হচ্ছে প্রচুর। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে একাধিক লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পায়নি।
পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করে অনাবাদি জমিগুলো আবাদের আওতায় আনতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা। একই কথা জানিয়েছেন পশ্চিম গোমদন্ডী ইউনিয়নের চরখিদিরপুর এলাকার কৃষক জামশেদ , সুমন বড়ুয়া, জয়দত্ত বড়ুয়া, মাহমুদ নবী ও আলী আজগর মিয়াসহ কয়েক’শ কৃষক। তারা বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষ।চরখিদিরপুর বড়ুয়া পাড়া বিল ও চরের বিলের পানি চলাচলের পথ ছিল কাকনিয়া খাল ও জেঠি খাল।
কাকনিয়া খালটি ইন্ডাস্ট্রির পেটে ঢুকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জেঠি খালটিও আধমরা। পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ করে
অপরিকল্পিত কালভার্ট নির্মাণের ফলে কোন কোন জমি ভেঙে খালে পরিণত হয়েছে। এজন্য চাষ করতে না পারায় কৃষকরা যেমন চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে তেমনি অনাবাদি জমির পরিমাণ বাড়ছে। এসব থেকে মুক্তি পেতে কাকনিয়া খাল দখলমুক্ত ও জেঠি খাল সংস্কারসহ নদীর তীরবর্তী এলাকায় বাঁধ নির্মাণ খালের সম্মুখে জলকপাট নির্মাণ করতে পারলে ঐ এলাকার জমিতে চাষ করতে পারবে বলে ধারণা করছেন কৃষকরা। তবে খাল ভরাট করে মিলকারখানা তৈরী কিংবা পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) কানিজ ফাতেমা।
এদিকে উপজেলার কধুরখীল এলাকার হদর বিল ও মাঝের বিলের জমিগুলোতে এক সময় চাষাবাদ হলেও বর্তমানে জলাবদ্ধতার কারণে চাষাবাদ হচ্ছে না কৃষকেরা বলেন, বিলে প্রায় ১৫ বছর ধরে চাষ হচ্ছে না। জমির মালিকরা ও চাষ করতে আগ্রহী না। তাই এসব জমি অনাবাদী হয়ে রয়েছে বছরের পর বছর।
এছাড়া বর্ষাকালে জোয়ারের পানিতে লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত বাড়ি নির্মাণ, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আতিক উল্লাহ বলেন, চাষ না হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে।যার প্রধান কারণ হলো জলাদ্ধতা আর জোয়ারের পানি।
জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খনন করে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা নিলেই চাষের আওতায় আসবে এসব অনাবাদি জমি। আরেকটি কারণ হলো কৃষকদের অনিহা।কৃষকরা চাষ করতে ইচ্ছা পোষণ করলে অনাবাদি জমি থাকবে না। এ ব্যাপারে সচেতনতার পাশাপাশি চাষের জমি রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনে বোয়ালখালী খাল ও ছন্দরিয়া খালের মুখে স্লুইস গেট স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিমাদ্রি খীসা বলেন, উপজেলার কয়েকটি বিলে পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে অপরিকল্পিত আবাসন, মিল কারখানা স্থাপন, খাল দখল দূষণ ও যত্রতত্র কালভার্টের কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। পড়ে থাকা অনাবাদি জমিগুলো চাষের আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে।